SATT ACADEMY

New to Satt Academy? Create an account


or
Log in with Google Account

একাদশ- দ্বাদশ শ্রেণি - বাংলা - সাহিত্যপাঠ | NCTB BOOK


একটানা খররৌদ্রে ক্ষেত-মাঠ ফেটে চৌচির হয়ে গিয়েছিল । চৈত্রমাস শেষ হয়ে গেল, তবু একফোঁটা জল নেই । এখনো দক্ষিণা হাওয়া কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে মৃদু মর্মর তুলে ঝিরঝিরিয়ে বয়, উদ্দাম হয়ে মৌসুমি সংবাদ আনে না। সময় সময় এমনও হয় যে নারকেল গাছের পাতাটি পর্যন্ত নড়ে না। পত্রঝরা গাছগুলির দিকে তাকিয়ে মনে হয়, এত তীব্র রৌদ্রে পুড়ে পুড়ে হঠাৎ বুঝি তা শুকনো ডালে আগুন ধরে যাবে।
প্রকৃতির এই রুক্ষতা নবাগত দ্বারিকানাথ দত্ত চৌধুরীর মেয়ে অনসূয়ার শহুরে প্রাণ উদাসীন করে তোলে; সে প্রেরণা পায় বটে রবি ঠাকুরের গান গাইবার, কিন্তু চাষিদের মুখ ক্রমান্বয়ে আমসি হয়ে আসে। তাদের ঘরে ঘরে মনে মনে নামে দুর্ভাবনার অন্ধকার ।
শুরু হয় জলের জন্যে কত রকম কান্নাকাটি। ধুমধাম করে এই সেদিন নীলপুজো করেছে, এবার মানে পিরের
দরগায় সিন্নি, জনে জনে মানত করে, বাড়ি বাড়ি কীর্তন দেয়, এমনকি মৌলভি ডেকে দল বেঁধে শুকনো ক্ষেতে
নেমে মিলাদও পড়ে। কিন্তু কোথায় দেয়ার গুরগুর ডাক! দেখে দেখে অনসূয়ার তো আর হাসি থামে না। ওমনি করে বুঝি জল নামাবে! তাহলে আর মেঘমাল্লার রাগ তৈরি হয়েছিল কেন ?
মা একরকম গাঁয়েরি মেয়ে, শহুরে বনতে পারেননি, তাছাড়া ঠাকুর-দেবতা নিয়ে হাসা-হাসি তাঁর ভালো লাগে না, তাড়া দিয়ে বলে ওঠেন : ওই-ই ওদের মেঘমল্লার তা বেশ তো যা না, তুই-ই যেয়ে নামা না জল! অনসূয়া ঠোঁট ওলটাতো : আমার বয়ে গেছে। জল নামলেই তো কাদা। হোক গরম, তবু এই-ই বেশ আছি বাবা! সত্যি বেশ আছে, অসুবিধা তো নেই-ই, ফুর্তিরও কমতি নেই অনসূয়ার। পাঁচ বছর বয়সে গ্রাম ছাড়ার পর এই আঠারো বছরে গ্রামে এসেছে সে। দিগন্ত বিস্তারিত খটখটে খোলা মাঠ । সকালে বিকেলে ভাই বোনসহ মাঠে-ঘাটে নেমে ছুটোছুটি করে লুকোচুরি খেলে সে যেন এক নতুন আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে লাগল ।
কিন্তু গাঁয়ের হাওয়া বড় অস্বস্তি বোধ করে। বুড়োরা আমল না দেয়ার ভান করে, ঝি বউ মাতারিরা গালে হাত লাগিয়ে অবাক হয়ে থাকে, আর জোয়ানদের কেবল চোখ টাটায়। ওরা যখন হালকা খুশিতে মাঠে মাঠে ছুটোছুটি করে হেসে হেসে লুটোপুটি খায়, ওদের চিন্তাক্লিষ্ট মনে তখন কেমন ঈর্ষার জ্বালা লাগে । মনে মনে বলে : সবুর, নামুক না দেয়াই! দেখবো তখন এতো ফুর্তি কোথায় থাকে!
বুড়ো সখানাথ একদিন ওদের পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে শোনে, দত্ত চৌধুরীর মেয়ে বলছে : আহা আরও কিছুকাল যদি এমনি থাকে! জামাই বাবু আর দিদি এলে আরও মজা করে বেড়ানো যাবে। কথাটা শুনে সখানাথের কেমন খারাপ লাগে। স্পষ্ট কথা বলা তার স্বভাব, তাই হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে : ছিঃ
ছিঃ কও কী সর্বনাশ্যা কতা!
দত্ত চৌধুরীর মেয়ে ভ্রু কোচকায়। মুখ লাল হয়ে ওঠে।
এবার সখানাথ একটু হাসে। দুপা এগিয়ে এসে আবার বলে : ছিঃ না, অমন কতা কইতে নাই । খরা থাকলে তোমাগো ভালো বই কি! কিন্তু মোগো যে সর্বনাশ। জল না অইলে ভাদ্দরইয়া ফসল যে পামু না ।
অনসূয়া বাদে অন্য সবাই তার কথা শুনে হেসে ওঠে। অনসূয়া নিচু স্বরে ভৃত্যকে শুধায়, কে রে লোকটা! ভারি
অভদ্রতা। গায়ে পড়ে কথা বলতে আসে।
: সখানাথ, গাঁয়ের চাষিদের মাতবর ।
: মাতবর কী?
: মানে মোড়ল ৷
: অ তাই যেখানে সেখানে-
: কথাগুলি সবই সখানাথের কানে যায়।
অভদ্র বইকি—তার ওই বক্তব্যের আড়ালে যে কান্না তা ওদের কানে পৌঁছায়নি। ওরা জমিদার, ওদের সুখ-দুঃখ হাসি-কান্নার সঙ্গে তাদের আসমান-জমিন ফারাক। ওরা এক জাত তারা অন্য। তাদের সর্বনাশেই তো ওদের পৌষমাস। এই তো রীতি ।
কিন্তু সখানাথের ছেলে রমানাথ বাপের মুখে ঘটনাটা শুনে চটে উঠলো। ইচ্ছে হলো, তখুনি ছুটে গিয়ে দুটো কথা শুনিয়ে দিয়ে আসে ।
কিন্তু নিরস্ত্র করল সখানাথ : রাগের কিছু নাই রে, অমন ওরা বলেই। অনসূয়া বাড়ি ফিরে বাপকে ঘটনাটা জানায় : দেখো তো কী আস্পর্ধা।
দ্বারিকানাথ বললেন : হু।
তিনি আরও অনেক শুনেছেন সখানাথের কথা । এখন নাকি সখানাথেরই মাতবরি : ওরই নেতৃত্বে সকলেরই বড় বাড় বেড়েছে। পাইক-পেয়াদা খাজনা চাইতে গেলে উলটে ধমকদিয়ে হাঁকিয়ে দেয়; পাই না খেতে, খাজনা দেবো কোত্থেকে? জমিদারকে নাকি ওরা গ্রাহ্যের মধ্যেই নেয় না আজকাল। গেল মাঘে কম্যুনিস্টরা না কারা যেন এসেছিল, তারা সখানাথের কানে যে মন্ত্রণা ঢেলে গেছে, এসব তারই ফল। এই তো প্রায় সপ্তাহখানেক হলো দেশে এসেছেন তিনি, অথচ একটা প্রজাকেও কাচারিতে চৌকাঠ মাড়াতে দেখা যাচ্ছে না ।
দিনকাল খারাপ, তাই ঘাঁটাতে সাহস করেন না দ্বারিকানাথ । নইলে
কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁকে রাগতেই হলো।
এতদিন গ্রামে এসেছেন অথচ একটা প্রজাও সেলাম ঠুকতে এলো না, ব্যাপারখানা কী? খবর দিলেও যে কেউ আসে না। মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছেন এই জ্যৈষ্ঠে, এখন কত লোকজন জোগাড় দরকার—
তাই সখানাথকে খবর পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তার ছেলে নাকি মারমুখে হয়ে পাইককে হাঁকিয়ে দিয়েছে, বলেছে : আকালের দিনে আমরা না খেয়ে মরেছি, আর তোমার কর্তামশাই তখন এখানের চাল শহরে নিয়ে ব্যবসা করেছেন। আমাদের অবস্থাটা একবার চক্ষেও দেখতে আসেননি। যে জমিদার প্রজাপালক হতে পারে, তেমন তোমাদের মনিব নয়। আজ দায় পড়েছে তাই ডাকতে এসেছ, কিন্তু তাঁকে বলোগে বাপু, জমিদার যখন আমাদের জানেনি, আমরাও তাঁকে চিনি না ।
শুনে আগুন হয়ে উঠলেন দ্বারিকানাথ। যে করে হোক ওদের শায়েস্তা করবার একটা দুর্দম ইচ্ছা হয়েছিল। ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে অথবা বাকি খাজনার দায়ে নিলাম করে তাড়িয়ে দিলে কে কী করতে পারবে তাঁর! কিন্তু নিষেধ করল নায়েব : না কর্তা, মামলা টামলা বা মারামারি করে সুবিধে হবে না। পেছনে স্বদেশিওয়ালারা রয়েছে, দেখছেন না কেমন সুন্দর দল পাকিয়েছে। এক্ষেত্রে চুপ করে ভবিষ্যতের অপেক্ষায় থাকাই ভালো, নইলে ব্যাপার অনেক দূর গড়াবে।
সারা বাংলাদেশে প্রজাক্ষেপানো কাণ্ডকারখানাগুলি স্মরণ করে দ্বারিকানাথ শেষ পর্যন্ত অপমানটা হজম করেই নিলেন। মানুষ তো নয়, আদিম বর্বর ওরা, একবার ক্ষেপিয়ে দিলে কে বলতে পারে কী করে বসে! তবে জব্দ সখানাথদের করা চাই-ই। তবে একটু সবুর, মেয়ের বিয়েটা তো ভালোয় ভালোয় হয়ে যাক । স্বদেশিওয়ালারা কথা শুনে রোমান্সের গন্ধ পায় বাংলা ফিল্ম দেখা অনসূয়া। জনান্তিকে নায়েবকে শুধায়—
স্বদেশিওয়ালাদের কথা যেন কী বলছিলেন কাকাবাবু, এখানেও আছে।: আছে বই কী!
: লিডার কে তাদের?
: আর লিডারের কথা জিগ্যেস করছো, সে কোনো ভদ্দরলোক নয়, ঐ সখানাথ আর তার ছেলে ব্ৰহ্মনাথই
ওদের লিডার ।
: ও! হতাশ হয়ে পড়ে অনসূয়া ।
এদিকে বৈশাখের প্রথম সপ্তাহটাও অনাবৃষ্টিতে কেটে যায়। সর্বত্র খা খা করে শুষ্কতায় ।
অবশেষে একদিন বিকেলে জোর হাওয়া দিল হঠাৎ। কয়েকটা দিন অসহ্য গুমোট ছিল। গাছের পাতাটি পর্যন্ত স্থির। আকাশেও ছিল না তীব্র রৌদ্র ঢাকা এক ফোঁটা মেঘ।
দারুণ গ্রীষ্মে যখন চারিদিক অস্থির, সেই সময় হঠাৎ একদিন হাওয়া এলো। আর সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ থেকে
দেখতে দেখতে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ এলো তার ধূসর পাল উড়িয়ে।
চাষিদের বুক আশায় কেঁপে ওঠে। আকাশের দিকে চেয়ে ‘আল্লা’ ‘আল্লা” করে। ভগবান বুঝি শুনেছেন কান্না ৷ ক্রমাগত দুদিন ধরে সেই হাওয়া তীব্রবেগে বইতে থাকে। নতুন আমের মুকুল উড়ে গেল দিক হতে দিগন্তরে । আর সেই হাওয়ার সাথে পাল্লা দিল মেঘ। গুরু গুরু করে তাদের সে কী ডাকাডাকি আর মাঝে মাঝে বিজলি জ্বেলে ফরকানি!
শেষে নামল জল । ঝরঝর করে যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। জল উঠল ক্ষেতে মাঠে। মেঘের ডাকে খালবিল ছেড়ে ওঠে, এলো হরেক রকম মাছ। রোজ রাত্রিবেলা ক্ষেতে ক্ষেতে মশাল জ্বেলে মাছ ধরার ধুম পড়ে গেল । গভীর রাত্রে অন্ধকার মাঠে মশাল জ্বেলে সেই সমস্ত ছায়ামূর্তিকে যখন জানলা খুলে দেখত অনসূয়া, দ্বারিকানাথ ধমকে উঠতেন : জানলা বন্ধ করে দাও অনু, ঠান্ডা লাগবে। এতো একেবারে সাগরের নোনা হাওয়া, লাগলেই সর্দিতে পড়বে।
অনসূয়া অগত্যা শুয়ে গান ধরত কিংবা খুলে পড়ত উপন্যাস।
যাই বলে থাকুক, দ্বারিকানাথ ভেবেছিলেন সখানাথ শেষ পর্যন্ত আসবেই; কিন্তু তেমন কোনো লক্ষণ না দেখে শেষে নিজেই একদিন বেরোলেন।
অবিশ্যি এছাড়া বেরোবার অন্য এক কারণ ছিল। ম্যাজিস্ট্রেট বাহাদুর তাঁকে এক ব্যক্তিগত চিঠি লিখে জানতে চেয়েছেন : শুনতে পেলাম তোমাদের এলাকায় অন্নাভাব শুরু হয়েছে, সত্যি কি না জানাও তো। এর উত্তর ঘরে বসে লিখে দিলেই চলত। কিন্তু তবু গ্রামটা একটু ঘুরে দেখবার ইচ্ছে হলো দ্বারিকানাথের । অনসূয়া সঙ্গী হলো ।
কিন্তু কই? ক্ষেতে ক্ষেতে চাষিরা যে গান গেয়ে হাল চষছে! সকলেরই মুখ হাসিখুশি। যেন নতুন করে জীবন
পেয়েছে সব। সব দুশ্চিন্তা উড়ে গেছে। ব্যাপার কী, চালের দর তো সত্যি সত্যি ত্রিশ টাকায় পৌঁছেছে, এ
অবস্থায় এমন তো হবার কথা নয়।
খোঁজ নিলেন, ঘরে খোরাকি রেখেছে কি না। কিন্তু তাও তো নয়। ঘুরে ঘুরে শেষে এলেন সখানাথের বাড়ি। সখানাথ কোথায় বসাবে, কী করে সমাদর করবে ভেবে আকুল । অনসূয়া গেলো, অন্দরে।
দ্বারিকানাথ জিগ্যেস করলেন : কী খবর সখানাথ, তোমার যে দেখা পাওয়াই ভার!
: আইজ্ঞা মরিচক্ষেত লইয়া বড় ব্যস্ত ছিলাম, তাছাড়া মাথায় মৌসুমের দুশ্চিন্তা, ভাবলাম যাই ধীরে সুস্থে-
: হু! তা কেমন কাটাচ্ছ আজকাল?
:আইজ্ঞা, আপনার আশীর্বাদে ভালোই!
কথাটা হাত কচলে বললে বটে সখানাথ, কিন্তু দ্বারিকানাথ যেন কেমন ব্যঙ্গের গন্ধ পান। একে গত খন্দ ভালো হয়নি, তার ওপর এবারে চালের দর ত্রিশ টাকা, সখানাথের তো তেমন অবস্থা নয় যে এ অবস্থাতেই ভালো থাকবে।
তবু না দমে আবার শুধান : শুনেছিলাম, সকলেরই নাকি খুব অভাব যাচ্ছে, কিন্তু কই, ফুর্তিতেই তো আছ সবাই। সেবার আকালটা হঠাৎ এলো কি না, তাই সামলাতে সত্যি বেগ পেয়েছ, এবার আর তেমন অবস্থা হবে
না, কী বল?
পানদানে করে পান নিয়ে এলো, সখানাথ তাই বাড়িয়ে দিয়ে বলে : ক্যামনে কই, মাথার উপরে আপনারা। তেমন অবস্থা না হওয়া, বাঁচা-মরার সবি তো আপনাগো হাতেই নির্ভর। দ্বারিকানাথ একটা পান তুলে মুখে দিতে দিতে কথাটা উড়িয়ে দিতে চান : আমাদের হাতে আর কী ক্ষমতা!
আজকাল জমিদারির কী অবস্থা তো জান না !
সখানাথের ছেলে হঠাৎ হেসে বললেন : অনেক ক্ষ্যামতা কর্তা। বাঁচাইতে না পারলেও মারতে তো পারেন। দ্বারিকানাথের হাত থেকে চুনের বোঁটা খসে পড়ে।
অনসূয়াও এই সময় অন্দর থেকে চোখ-মুখ লাল করে ফিরে আসছিল, কথাটা শুনে সেও ভ্রু কোঁচকাল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন দ্বারিকানাথ, তারপর হাসার চেষ্টা করে বললেন : হে, হে, তা বেশ বলেছ । এই বুঝি তোমার ছেলে সখানাথ ।
: আইজ্ঞা হ, ওরে বেটা পেন্নাম কর।
সখানাথ তাড়া দিলেও রমানাথের দিক থেকে তার কোনো উৎসাহ দেখা যায় না । শেষ পর্যন্ত দ্বারিকানাথই বলে ওঠেন : থাক থাক, আর পেন্নাম করতে হবে না। বেশ ছেলে ।
অনসূয়া ডাকল : বাবা!
হ্যাঁ, এই উঠছি। তোমার ছেলেকে কাল একবার পাঠিয়ে দিও সখানাথ ।
সখানাথ হাত কচলে বললে : সে আপনেই কইয়া যান । আমার কথা আবার শোনে কি না ৷ কথাটা খেয়াল করে কান লাল হয়ে ওঠে দ্বারিকানাথের। তবু ফিরে দাঁড়িয়ে সখানাথের ছেলের উদ্দেশে মিষ্টি
করে হাসার চেষ্টা করেন : বাপের কথা শোন না বুঝি? ছিঃ বাবা, উদ্ধত হতে নেই! চুপ করে নতমুখ হয়ে রইল, তবে তার চেপে মুখে যে ভাব ফুটে উঠল, তাকে বিরক্তি প্রকাশ ছাড়া অন্য কিছু ভাবা যায় না। কিন্তু দ্বারিকানাথ তা খেয়াল না করার ভান করে তাড়াতাড়ি পা বাড়ালেন। আচ্ছা, আমি চলি, তুমি কাল এসো একবার। তোমার মতো জোয়ান ছেলেই আমার দরকার —
: আমি যাইতে পারমু না ।
কথার মাঝখানেই রমানাথের জবাবটা যেন শপাং করে দ্বারিকানাথের গায়ে এসে পড়ল । চোখ জ্বলে উঠল, কিন্তু পর মুহূর্তেই সামলে নিলেন। তবু হাসির চেষ্টা করে মোলায়েম স্বরে শুধালেন : কেন ?
: বাড়িতে কাজ আছে ।
আবার সেই চাবুকের মতো জবাব। যেমন সংক্ষিপ্ত, তেমনি দৃঢ়। গোঁয়ারের মতো মাটির দিকে তাকিয়ে আছে । : আঃ হারামজাদা, আদব করে বল! সখানাথ তাড়া দিয়ে ওঠে। অনসূয়ার চোখ তখন আগুন, ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে হাত ধরে ঝাঁকুনি দিল দ্বারিকানাথের : বাবা! বলছে কাজ আছে, তবু ওর মতো লোককে তোমার কী এমন দরকার পড়ল? এইবার রমানাথ বাঁকা চোখে একটু চাইলে তার দিকে । অনসূয়া দেখলে তার মুখ যেমন তৃপ্তিতে কঠিন তেমনি ব্যঙ্গ ভরা।
হাত ধরে এবার যেন সে টেনে নিয়ে যেতে চাইল দ্বারিকানাথকে ।
কিন্তু আশ্চর্য দ্বারিকানাথের সামলে নেবার শক্তি । প্রচণ্ড প্রতাপ পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্যবহ রক্ত গরম হয়ে উঠলেও –ও, তাহলে থাক, তাহলে থাক—বলতে বলতে আবার তিনি বললেন : তাহলে তুমিই যেয়ো সখানাথ ।
: যাবো। একটু নরম সুরে সম্মতি কবুল করে পিছু পিছু যেতে লাগল সখানাথ । মুখে ছিল অজস্র প্যাচাল। অনসূয়া বা দ্বারিকানাথ কেউ সেদিকে কান দিল না। অথচ এবার খাঁটি কথাই বলছিল সখানাথ। চারদিকের অবস্থা সত্যিই খারাপ। ঘরে কেউই ধান চাল রাখেনি, কেমন করে বুঝবে যে এবারও এমনি বাজার চড়বে। এখন কী করে যে দুমুঠো জুটবে সে-ভাবনায় সবাই অস্থির। বাইরে এ আনন্দ তো নতুন মৌসুম পাওয়ার। আচ্ছা সেবার শুনলাম বর্মা শত্রুদের হাতে যাওয়ায় চালের দাম বেড়েছিল, কিন্তু এবার— হঠাৎ দ্বারিকানাথকে ঘুরে দাঁড়াতে দেখে কথা থেমে গেল সখানাথের
আচ্ছা সখানাথ, এত ঔদ্ধত্য তোমরা কোথায় পেলে বলো তো? ভাবছ বুঝি আমি এর প্রতিকার জানিনে?
 : সে কী কতা কর্তা, ঔদ্ধত্য কই! ও, ছেলেটার কতা কইতে আছেন বুঝি? তা ওটা বরাবরই একটু
এইরকম। তা ওর কতা ধইরেন না আপনি কর্তা, ওর হইয়া আমি মাপ চাই ৷ আবার কথা কাটাকাটির উপক্রম দেখে অনসূয়া ডাকে : বাবা! এই অভদ্রগুলোর সঙ্গে তবু তুমি কথা না বলে পারবে না?
সখানাথ হঠাৎ কঠিন হয়ে দাঁড়াল ।
দ্বারিকানাথ একটু নরম হয়ে বলেন : না, না, তোমার মাপ চাইবার কিছু নেই, সখানাথ। মাপ আমি করবই, যদি ও কাল আমার ওখানে আসে। তা তোমার ও ছেলেকে একটু বলে দিও সখানাথ, সে তো জানোই, কথা না মানার দরুন ওর ঠাকুরদাকে কাঁধের চাদর দিয়ে এক মাস আমার বাসায় জুতো মুছে দিতে হয়েছিল। হয়ত ও তা জানে না!
বাঁকা বিদ্রূপে সখানাথের চোখ বুঝি-বা মুহূর্তের জন্যে জ্বলে উঠল : খুব জানে কর্তা। সেই অপমান ভুলতে না পাইরাই তো আপনাগো উপর ওর অত ঘেন্না ।
এবার আর আত্মসংবরণ করতে না পেরে হঠাৎ হনহন করে এগিয়ে গেলেন দ্বারিকানাথ । সখানাথ চোখ তুলে তাকাল আকাশের দিকে। মেঘে মেঘে ছেয়ে গেছে চতুর্দিক। বেগবন্ত হাওয়ায় দূর-সমুদ্রগান। অগ্নিবরণ কৃষ্ণচূড়া ধূসর আকাশের গায়ে যেন আরও রক্তলাল। সখানাথ তৃপ্ত হয়ে চোখ বুজল : আ, আরও তীব্র মৌসুম এনে দাও ভগবান শোষণশুষ্ক পৃথিবীতে, আমাদের তৈরি ক্ষেতে আরও জাগুক নবজীবনতেজা অঙ্কুর । দ্বারিকানাথ হন হন করে হাঁটছিলেন।
পেছনে অনসূয়া । নাকে তার ফোঁসানি : কেন অপমানিত হতে গেলে বাবা ?
: তোকেও বলেছে নাকি কিছু?
: বলেনি! কম্যুনিস্টদের শেখানো কথা। বলে কিনা, তুমি চোরা কারবারি। পঞ্চাশ সনে মানুষের জান নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছ?—
: হুঁ! আচ্ছা দাঁড়া মজা দেখাচ্ছি!
দেহের মধ্যে উষ্ণ রক্ত যেন টগবগ করে ফুটতে থাকে। এই গ্রামের দণ্ডমুণ্ড-বিধাতাদেরই বংশধর দ্বারিকানাথ দত্ত চৌধুরী যা হুকুম দিয়েছেন, বিনা বাক্যব্যয়ে সব প্রজা তাই পালন করে ধন্য হয়েছে, এই-ই দেখে এসেছেন এতদিন । তার সামনে দাঁড়িয়ে কথা দূরের কথা, তাকাতেও ভয় পেত। হঠাৎ সেই নিয়ম ভাঙার সাহস কারা জুগিয়েছে তা বুঝতে কষ্ট হয় না । তাই ধীরে ধীরে দ্বারিকানাথের মনের ক্রোধটা বেশির ভাগ তাদেরই ওপর গিয়ে বর্তায় ।
: দাঁড়া খুঁজে বার করি পিছনে কারা আছে। তারপর—
: সখানাথ বললে কী শুনলে বাবা? মৌসুম পেয়েই না কি এত ফুর্তি, আর তারি জন্যে ওরা নাকি সবাই
একটু বেসামাল ।
 : মৌসুম! মনে মনে ক্রূর হেসে ওঠেন দ্বারিকানাথ। মৌসুমই বটে । :
কিন্তু জাদু, যারা তোমাদের নাচিয়ে দিয়েছে, তারা আবার ফাটকে পচতে গেল বলে! (সেটুকু ব্যবস্থাও করতে না পারলে এতকাল জজ, ম্যাজিস্ট্রেট, এসপির সঙ্গে খানাপিনা আর খাতির করার মূল্য কী!) তারপর দাঁড়াও না, মৌসুম না হয় পেয়েছই, কিন্তু বর্ষা নামার সঙ্গে সঙ্গেই আসবে যে আকাল কোন পুঁজি দিয়ে তাকে ঠেকাবে। আমার স্টক-করা চালের দাম তখন চড়চড় করে আরও বেড়ে যাবে। তখন কার দুয়ারে মাথা কোটো দেখব না ! আমি ম্যাজিস্ট্রেটকে আজই লিখে দেব : কোনো অভাব নেই, কিছু করতে হবে না তোমার । সবুর! এ ফুর্তি আর কদিনের, আমারও মৌসুম সমাগত ।
যেতে যেতে আবার জীবনের ওপর দোর্দণ্ড প্রতাপের সেই আগামী দিন কল্পনা করে খুশি হয়ে ওঠেন দ্বারিকানাথ। তারপর যেন অনেক গলার কেমন একটা আওয়াজ শুনে একবার পিছন দিকে তাকান। হাওয়ায় একটা দূরাগত হাসির রোল ভেসে আসছে নাকি ?
[সংক্ষেপিত]

Content added By


বাংলা কথাসাহিত্যে শামসুদ্দীন আবুল কালাম একটি বিশিষ্ট নাম। তাঁর জন্ম ১৯২৫ সালে বরিশাল জেলার নলছিটি থানার কামদেবপুর গ্রামে । তাঁর প্রকৃত নাম আবুল কালাম শামসুদ্দীন। প্রথমে এই নামেই তিনি লিখতেন। কিন্তু এই নামে বাংলা সাহিত্যে আরও একজন খ্যাতিমান লেখক থাকায় তিনি পরবর্তীকালে নিজের লেখক-নাম পরিবর্তন করেন। তিনি বরিশাল ও কলকাতায় শিক্ষা গ্রহণ করেন । পঞ্চাশের দশকে তিনি ঢাকায় সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। পঞ্চাশের দশকের শেষে তিনি রোম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিলিট ডিগ্রি লাভ করেন এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন।
বাংলাদেশের একটি বিশেষ অঞ্চলের জীবনপ্রবাহকে শামসুদ্দীন আবুল কালাম তাঁর সাহিত্যে প্রাণবন্তরূপে পরিবেশন করেছেন। গ্রামীণ মানুষের ভাষাভঙ্গি, মনোভঙ্গি ও রুচিকে তিনি যথাযথভাবে সাহিত্যরূপ দিতে সচেষ্ট হয়েছেন। একটি জনপদ, তার জনগোষ্ঠীর জীবনধারা ও জীবনদর্শনের সারসত্যকে তিনি রূপায়ণ করেছেন তাঁর কথাসাহিত্যে। নিম্নবর্গের শ্রমজীবী মানুষের প্রতি ছিল তাঁর প্রগাঢ় সহানুভূতি । তাঁর গল্প-উপন্যাসে সমকালীন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকট চিত্রিত হয়েছে। তাঁর গল্পগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে : ‘শাহেরবানু’, ‘পথ জানা নেই”, ‘অনেক দিনের আশা’, ‘দুই হৃদয়ের তীর' প্রভৃতি। তাঁর বিখ্যাত কয়েকটি উপন্যাস হলো : ‘কাশবনের কন্যা', ‘কাঞ্চনমালা', ‘সমুদ্রবাসর’, ‘কাঞ্চনগ্রাম’ ইত্যাদি। সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন । ১৯৯৭ সালের ১০ই জানুয়ারি তিনি ইতালির রোমে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
 

Content added By


মৌসুম সংবাদ - দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ থেকে প্রবাহিত জলীয় বাষ্পপূর্ণ বায়ু যা বর্ষা ঋতুর সূচনা ঘটায় সেটাই মৌসুমি বায়ু নামে পরিচিত। এখানে মৌসুম সংবাদ বলতে বর্ষার আগমন সংবাদের কথা বলা হয়েছে।
দেয়া - মেঘ।
মেঘমল্লার রাগ  - সংগীতের একপ্রকার রাগ, যা বর্ষা ঋতুর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
মাতারি - একটি আঞ্চলিক শব্দ যা দিয়ে নারীকে বোঝানো হয়।
ভাদ্দরইয়া ফসল -  ভাদ্র মাসে পাকে এমন ফসল বা ধান।
 তাদের সর্বনাশেই তো ওদের পৌষমাস - একটি প্রবাদ আছে : কারো পৌষমাস, কারো সর্বনাশ। অর্থাৎ একটি ঘটনা যখন কারো জন্য আনন্দ নিয়ে আসে অথচ অন্যদের তা নিরানন্দের কারণ হয় । এখানে অনাবৃষ্টি যখন জমিদার-কন্যার সুখের কারণ তখন তা কৃষকদের জন্য সর্বনাশস্বরূপ । 
আস্পর্ধা  - দর্প । দুঃসাহস।
স্বদেশিওয়ালা - ব্রিটিশ শাসনামলে স্বদেশের অর্থাৎ ভারতের স্বাধীনতার জন্য নিঃস্বার্থভাবে জীবনপণ লড়াইয়ে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ।
ফরকানি -  ঠিকরে বার হওয়া। মেঘের মধ্য থেকে বিদ্যুতের বের হওয়াকে বোঝানো হয়েছে ।
নোনা হাওয়া - লবণাক্ত বায়ু । সমুদ্র থেকে বয়ে আসা বাতাস ।
খন্দ - ফসল, শস্য। ফসলের মৌসুম।
কম্যুনিস্ট - কমিউনিজম তথা সাম্যবাদ বা শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য যারা সংগ্রামশীল ।
 

Content added By


“মৌসুম” গল্পটি লেখকের ‘অনেক দিনের আশা' (১৯৫২) নামক গল্পগ্রন্থে সংকলিত। ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষ পরবর্তীকালের কাহিনি নিয়ে এ গল্প রচিত হয়েছে। তখন দেশে জমিদারি ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। জমিদারের শোষণের বিরুদ্ধে কৃষকদের মধ্যে যে নতুন চেতনা সৃষ্টি হয়েছে সেটাই গল্পের মূল বিষয় । আর কৃষকদের মধ্যে এই নতুন উপলব্ধি জাগিয়ে তোলার মূলে সক্রিয় ছিল সমাজরূপান্তরকামী কমিউনিস্ট ও স্বাধীনতাকামী স্বদেশিওয়ালারা । অনাবৃষ্টি শেষে বৃষ্টির আগমনে কৃষকরা, আর্থিক দুর্দশা সত্ত্বেও ভবিষ্যৎ ফসলের কথা ভেবে আনন্দে মাতোয়ারা হয় । ঘরে খাদ্য না থাকলেও নতুন ফসলের স্বপ্নে তারা বিভোর । এই আনন্দ জমিদার সহ্য করতে পারে না। অন্যদিকে শোষক জমিদারের কৃষকবিরোধী কর্মকাণ্ডে তরুণ কৃষকদের মধ্যে যে প্রতিবাদী মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে তা দমনে নতুন পরিকল্পনা আঁটে জমিদার । চাল মজুদ করে দাম বাড়িয়ে সংকট সৃষ্টি করে জমিদার কৃষকদের ওপর প্রতিশোধ নিতে চায়। শোষক জমিদারের প্রজাবিরোধী স্বার্থপরায়ণতার বিপরীতে কৃষককুলের জাগরণের ইঙ্গিতেই গল্পটি তাৎপর্যবহ। নতুন কালের বাস্তবতা ও ব্যঞ্জনা নিয়ে গল্পটি বিশেষত্বমণ্ডিত।
 

Content added By
Promotion
Content for the offcanvas goes here. You can place just about any Bootstrap component or custom elements here.