SATT ACADEMY

New to Satt Academy? Create an account


or
Log in with Google Account

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বাংলা সাহিত্য - গদ্য | NCTB BOOK

বাংলা ভাষার একরকম শব্দকে বলা হয় ‘তদ্ভব শব্দ'। আরেক রকম শব্দকে বলা ‘তৎসম শব্দ'। এবং আরেক রকম শব্দকে বলা হয় ‘অর্ধতৎসম শব্দ'। এ-তিন রকম শব্দ মিলে গড়ে উঠেছে বাংলা ভাষার শরীর। ‘তৎসম’, ‘তদ্ভব’ পারিভাষিক শব্দগুলো চালু করেছিলেন প্রাকৃত ভাষার ব্যাকরণ রচয়িতারা । তাঁরা ‘তৎ’ অর্থাৎ ‘তা’ বলতে বোঝাতেন ‘সংস্কৃত' (এখন বলি প্রাচীন ভারতীয় আর্য) ভাষাকে । আর ‘ভব’ শব্দের অর্থ ‘জাত, উৎপন্ন’। তাই ‘তদ্ভব' শব্দের অর্থ হলো ‘সংস্কৃত থেকে জন্ম নেয়া’, আর ‘তৎসম’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘সংস্কৃতের সমান' অর্থাৎ সংস্কৃত। বাংলা ভাষার শব্দের শতকরা বায়ান্নটি শব্দ ‘তদ্ভব’ ও অর্ধ-তৎসম'। শতকরা চুয়াল্লিশটি ‘তৎসম’। তাই বাংলা ভাষার শতকরা ছিয়ানব্বইটিই মৌলিক বা বাংলা শব্দ ।
প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার বিপুল পরিমাণ শব্দ বেশ নিয়মকানুন মেনে রূপ বদলায় মধ্যভারতীয় আর্যভাষায় অর্থাৎ প্রাকৃতে। পরিণত হয় প্রাকৃত শব্দে। শব্দগুলো গা ভাসিয়ে দিয়েছিলো পরিবর্তনের স্রোতে। প্রাকৃতে আসার পর আবার বেশ নিয়মকানুন মেনে তারা বদলে যায়। পরিণত হয় বাংলা শব্দে । এগুলোই তদ্ভব শব্দ । এ-পরিবর্তনের স্রোতে ভাসা শব্দেই উজ্জ্বল বাংলা ভাষা। তবে তদ্ভব শব্দগুলো সংস্কৃত বা প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা থেকেই শুধু আসেনি। এসেছে আরো কিছু ভাষা থেকে। তবে প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা থেকেই এসেছে বেশি সংখ্যক শব্দ ।
‘চাঁদ', ‘মাছ’, ‘এয়ো’, ‘দুধ' 'বাঁশি'। এগুলো প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা থেকে নিয়ম মেনে প্রাকৃতের ভেতর দিয়ে এসেছে বাংলায়। ‘চাঁদ' ছিল সংস্কৃতে 'চন্দ্র', প্রাকৃতে ছিল ‘চন্দ’। বাংলায় চাঁদ। ‘মাছ’ ছিল ‘মৎস্য' সংস্কৃতে, প্রাকৃতে হয় ‘মচ্ছ’। বাংলায় ‘মাছ’ ৷ ‘এয়ো’ ছিল সংস্কৃতে ‘অবিধবা’। প্রাকৃতে হয় ‘অবিহবা’। বাংলায় ‘এয়ো’। দুধ’ ছিল সংস্কৃতে ‘দুগ্ধ”; প্রাকৃতে হয় ‘দুদ্ধ'। বাংলায় হয় ‘দুধ'। ‘বাঁশি ছিল ‘বংশী' সংস্কৃতে। প্রাকৃতে হয় ‘বংসী’। বাংলায় ‘বাঁশি’। বেশ নিয়ম মেনে, অনেক শতক পথ হেঁটে এসেছে এ-তীর্থযাত্রীরা। আমাদের সবচেয়ে প্রিয়রা।
আরো আছে কিছু তীর্থযাত্রী, যারা পথ হেঁটেছে আরো বেশি। তারা অন্য ভাষার। তারা প্রথমে ঢুকেছে সংস্কৃতে, তারপর প্রাকৃতে। তারপর এসেছে বাংলায়। এরাও তদ্ভব শব্দ । মিশে আছে বাংলা ভাষায় ।‘খাল’ আর ‘ঘড়া’। খুব নিকট শব্দ আমাদের। ‘খাল' শব্দটি তামিল ভাষার 'কাল' থেকে এসেছে। ‘কাল’ সংস্কৃতে হয় ‘খল্প'। প্রাকৃতে হয় ‘খল্ল’। বাংলায় ‘খাল’। তামিল-মলয়ালি ভাষায় একটি শব্দ ছিল ‘কুটম’। সংস্কৃতে সেটি হয় ঘট। প্রাকৃতে হয় ‘ঘড়’। বাংলায় ‘ঘড়া’।
‘দাম’ আর ‘সুড়ঙ্গ’। প্রতিদিনের শব্দ আমাদের। ‘দাম' শব্দটি এসেছে গ্রিক ভাষার ‘দ্রামে' (একরকম মুদ্রা, টাকা) থেকে। ‘দ্রামে' সংস্কৃতে হয় দ্রম্য’। প্রাকৃতে ‘দম্ম’। বাংলায় ‘দাম’। গ্রিক ভাষায় একটি শব্দ ছিল ‘সুরিং’। শব্দটি সংস্কৃতে ঢুকে হয়ে যায় ‘সরঙ্গ’/সুরুঙ্গ' । প্রাকৃতেও এভাবেই থাকে। বাংলায় হয়ে যায় ‘সুড়ঙ্গ’। ‘ঠাকুর’। বাংলায় শ্রেষ্ঠ কবির নামের অংশ। শব্দটি ছিল তুর্কি ভাষায় ‘তিগির' । সংস্কৃত ও প্রাকৃতে
হয়ে যায় ‘ঠকুর’ । বাংলায় ‘ঠাকুর’।
প্রাচীন ভারতীয় আর্য বা সংস্কৃত ভাষার বেশ কিছু শব্দ বেশ অটল অবিচল । তারা বদলাতে চায় না । শতকের পর শতক তারা অক্ষয় হয়ে থাকে। এমন বহু শব্দ, অক্ষয় অবিনশ্বর শব্দ, এসেছে বাংলায় । এগুলোকে বলা হয় তৎসম শব্দ। বাংলা ভাষায় এমন শব্দ অনেক। তবে এ-শব্দগুলো যে একেবারে বদলায়নি, তাও নয়। এদের অনেকে পরিবর্তিত হয়েছিল, কিন্তু আমরা সে-পরিবর্তিত রূপগুলোকে বাদ দিয়ে আবার খুঁজে এনেছি খাঁটি সংস্কৃত রূপ
জল, বায়ু, আকাশ, মানুষ, গৃহ, কৃষ্ণ, অন্ন, দর্শন, দৃষ্টি, বংশী, চন্দ্র এমন শব্দ। এদের মধ্যে ‘বংশী' ও ‘চন্দ্র’র তদ্ভব রূপও আছে বাংলায়। ‘বাঁশি' আর 'চাঁদ'। পুরোনো বাংলায় ‘সসহর’ ছিল, ‘রএণি’ ছিল। এখন নেই। এখন আছে সংস্কৃত শব্দ শশধর’ আর ‘রজনী'। বাংলা ভাষার জন্মের কালেই প্রবলভাবে বাংলায় ঢুকতে থাকে তৎসম শব্দ । দিন দিন তা আরো প্রবল হয়ে ওঠে ৷ উনিশ শতকে তৎসম শব্দ বাংলা ভাষাকে পরিণত করে তার রাজ্যে ।
কিছু শব্দ বেশ রুগ্‌ণ এসেছে বাংলায়। প্রাচীন ভারতীয় আর্য বা সংস্কৃতের কিছু শব্দ কিছুটা রূপ বদলে ঢুকেছিল প্রাকৃতে। তারপর আর তাদের বদল ঘটেনি। প্রাকৃত রূপ নিয়েই অবিকশিতভাবে সেগুলো এসেছে বাংলায়। এগুলোকেই বলা হয় অর্ধ-তৎসম। ‘কৃষ্ণ' ও 'রাত্রি' বিকল হয়ে জন্মেছে ‘কেষ্ট’ ও ‘রাত্তির' । শব্দগুলো বিকলাঙ্গ । মার্জিত পরিবেশে সাধারণত অর্ধ-তৎসম শব্দ ব্যবহার করা হয় না । আরো কিছু শব্দ আছে, যেগুলোর মূল নির্ণয় করতে পারেননি ভাষাতাত্ত্বিকেরা। তবে মনে করা হয় যে বাংলা ভাষার উদ্ভবের আগে যেসব ভাষা ছিল আমাদের দেশে, সেসব ভাষা থেকে এসেছে ওই শব্দগুলো। এমন শব্দকে বলা হয় 'দেশি' শব্দ। এগুলোকে কেউ কেউ বিদেশি বা ভিন্ন ভাষার শব্দের মতোই বিচার করেন। কিন্তু এগুলোকেও গ্রহণ করা উচিত বাংলা ভাষার নিজস্ব শব্দ হিসেবেই। ডাব, ডিঙ্গি, ঢোল, ডাঙ্গা, ঝোল, ঝিঙ্গা, ঢেউ এমন শব্দ । এগুলোকে কী করে বিদেশি বলি ?

Content added By

বাংলাদেশের বিশিষ্ট গদ্যশিল্পী, ভাষাবিজ্ঞানী, ঔপন্যাসিক ও কবি হুমায়ুন আজাদ ১৯৪৭ সালের ২৮শে এপ্রিল মুন্সীগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরের অন্তর্গত রাড়িখাল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। অত্যন্ত মেধাবী হুমায়ুন আজাদ দীর্ঘদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো : কাব্য— অলৌকিক ইস্টিমার, জ্বলো চিতাবাঘ, সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে, কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু; উপন্যাস— ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল, সব কিছু ভেঙে পড়ে, গল্প- যাদুকরের মৃত্যু, প্রবন্ধ— নিবিড় নীলিমা, বাঙলা ভাষার শত্রুমিত্র, বাক্যতত্ত্ব, লাল নীল দীপাবলি, কতো নদী সরোবর ইত্যাদি। তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ অন্যান্য অনেক পুরস্কার লাভ করেছেন। হুমায়ুন আজাদ ২০০৪ সালের ১২ই আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন।

Content added By

তদ্ভব শব্দ— তা থেকে উৎপন্ন, প্রাকৃত বাংলা শব্দ, এই শব্দগুলো প্রাচীনভারতীয় আর্যভাষা থেকে বিভিন্ন স্তরের মাধ্যমে ক্রম পরিবর্তিত হয়ে রূপান্তর লাভ করেছে

তৎসম শব্দ— তৎসদৃশ, তদ্রুপ, সংস্কৃত শব্দের অনুরূপ বাংলা শব্দ। অর্ধ-তৎসম শব্দ— অর্ধেক তার সমান, তৎসম শব্দের আংশিক পরিবর্তিত রূপ।

প্রাকৃত— প্রকৃতিজাত, স্বাভাবিক, প্রাচীনভারতীয় আর্যভাষার রূপান্তর বিশেষ। এ-তীর্থযাত্রীরা- এখানে বাংলা ভাষায় আগত শব্দভাণ্ডারকে বোঝানো হয়েছে।

আমাদের সবচেয়ে প্রিয়রা— বাংলা ভাষায় আগত শব্দসমূহ আমাদের বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে। এ কারণে আগত শব্দসমূহকে লেখক সবচেয়ে প্রিয় বলে বিশেষায়িত করেছেন।

অবিকশিতভাবে- বিকশিত নয়, এমন। বিকলাঙ্গ— ত্রুটিযুক্ত অঙ্গ ।

Content added By

হুমায়ুন আজাদের কতো নদী সরোবর বা বাঙলা ভাষার জীবনী নামক গ্রন্থ থেকে বাঙলা শব্দ প্রবন্ধটি সংকলিত হয়েছে। বাংলা ভাষার শব্দসম্ভারকে যে প্রচলিত পাঁচটি ভাগ করা হয়েছে তার তৎসম, অর্ধ-তৎসম, তদ্ভব ও দেশি শব্দ নিয়েই প্রবন্ধটিতে আলোচনা করা হয়েছে । কীভাবে অন্যান্য ভাষা থেকে শব্দসমূহ বাংলা ভাষায় এসে বাংলা-ভাষার শব্দভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে— তা অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় লেখক এখানে তুলে ধরেছেন। ‘বাংলা শব্দ' প্রবন্ধটি মূলত বাংলা শব্দের উৎস ও বিবর্তন সম্পর্কিত ধারণা দেওয়ার পাশাপাশি ভাষাসচেতনতা সৃষ্টিতে সহায়ক ।

Content added By
Promotion
Content for the offcanvas goes here. You can place just about any Bootstrap component or custom elements here.